নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/ষষ্ঠ অধ্যায় - উইকিসংকলন একটি মুক্ত পাঠাগার


Article Images

নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়

আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও

লোহিত জাতি

 আমি যখন ওয়াশিংটনে পড়িতেছিলাম তখন ওয়েষ্ট ভার্জ্জিনিয়াপ্রদেশে একটা তুমুল আন্দোলন চলিতেছিল। একটা নূতন স্থানে প্রদেশের রাষ্ট্র-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা উঠিয়াছিল। ঐ জন্য দুই তিনটি স্থানও নির্ব্বাচিত হইয়াছিল। সেই স্থানগুলির অধিবাসীরা নিজ নিজ নগরের জন্য প্রদেশময় আন্দোলন সৃষ্টি করিতে লাগিল। আমার ম্যাল্‌ডেনপল্লীর পাঁচ মাইল দূরেই চালর্ষ্টান-নগর অবস্থিত। এই নগরবাসীরাও রাষ্ট্র-কেন্দ্রের মর্য্যাদা লাভ করিবার জন্য চেষ্টা করিতে ত্রুটি করে নাই। আমি ওয়াশিংটনের ছুটির পর গৃহে ফিরিয়া আসিয়াছি, এমন সময়ে দেখি আমার নিকট চার্লষ্টনের শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা দলবদ্ধভাবে একখানা পত্র লিখিয়াছেন। আমাকে তাঁহারা তাঁহাদের জন্য ভোট সংগ্রহ কার্য্যে আহ্বান করাই এই পত্রের উদ্দেশ্য। আমি তাঁহাদের হইয়া প্রদেশের নানা স্থানে ‘ক্যান্‌ভ্যাস’ করিয়া বেড়াইতাম। তিনমাস কাল পল্লীতে পল্লীতে বক্তৃতা দিয়া চার্লষ্টনের দিকে জনগণের সহানুভূতি আকৃষ্ট করিলাম। ফলতঃ শেষ পর্য্যন্ত চার্লষ্টনের অধিবাসিগণই জয়ী হইল। সেই সময় হইতে এখন পর্য্যন্ত চার্লষ্টন নগরই ওয়েষ্ট ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশের রাষ্ট্র-কেন্দ্র এবং প্রধান নগর রহিয়াছে।

 এই আন্দোলনে যোগদান করিয়া আমি বেশ একটু নাম করিয়া ফেলিলাম। অনেক স্থান হইতেই আমাকে লোকেরা রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করিতে অনুরোধ করিল। কত দলপতি ও জন-নায়ক আমাকে তাঁহাদের দলে ঢুকিতে আহ্বান করিলেন। আমি কিন্তু হুজুগে মাতিলাম না—সাময়িক যশোলাভের মোহে পড়িলাম না। বরং সেই প্রলোভন কাটাইয়া উঠিয়া আমার জাতির স্থায়ী উন্নতিবিধানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠায়ই চিত্ত সমর্পণ করিলাম। আমি জানিতাম, যে রাষ্ট্রীয়-জীবনে যোগদান করিলে আমি কৃতকার্য্য হইয়া নামজাদা লোকই হইতে পারি। রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের কর্ম্ম করিবার যোগ্যতা, প্রবৃত্তি ও উৎসাহ সবই আমার ছিল। কিন্তু উহাতে লাগিয়া গেলে আমার স্বার্থপরতাই প্রমাণিত হইত। আমার নিজ উন্নতির পথ উন্মুক্ত হইত বটে, কিন্তু আমার সমাজকে আত্মপ্রতিষ্ঠ করিয়া উঠিতে পারিতাম না।

 আমি বুঝিয়াছিলাম সমাজকে আত্মপ্রতিষ্ঠ করিতে হইলে তিনটি কার্য্য করিতে হইবে। প্রথমতঃ সমাজের সকল স্তরে শিক্ষা বিস্তার করা আবশ্যক। দ্বিতীয়তঃ আমাদের কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায় পুষ্ট করা আবশ্যক। তৃতীয়তঃ আমেরিকার সমাজে নিগ্রোদিগের জন্য সম্পত্তি, গৃহ, জমিদারী ইত্যাদি সঞ্চিত করা আবশ্যক। এই তিনটির কোনটিই তখন আমাদের কৃষ্ণাঙ্গসমাজে ছিল না বলিলেই চলে। সুতরাং সমাজের এই তিনটি প্রাথমিক অভাব মোচন করাই আমার কর্ত্তব্য বিবেচনা করিলাম। তাহা না করিয়া আমি যদি প্রথমেই নিজ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে মাতিয়া যাই তাহা হইলে আমাকে স্বার্থপর এবং আত্মহিতাকাঙ্ক্ষী ভিন্ন আর কি বলা যাইতে পারে? কাজেই আমার নিজের সুযোগ, সুবিধা, ক্ষমতা, যোগ্যতা, পাণ্ডিত্য, যশোলাভ ইত্যাদি সকল কথা ভুলিয়া গেলাম। নিগ্রোসমাজকেই আমার জননীস্থানীয় বিবেচনা করিয়া একমাত্র তাহারই সুখবিধানে নিজকে নিযুক্ত করিলাম। আমার জীবনব্যাপিণী সাধনার কেন্দ্রস্থলে নিগ্রোসমাজকে রাখিয়া আমার ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জ্জন দিলাম। এই সমাজ-সেবা ব্রত হইতে কোনরূপ প্রলোভনই আমাকে টলাইতে পারে নাই।

 নিগ্রোজাতির অনেকেই রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে যোগ দিলেন। অনেকেই যুক্ত-দরবারের ‘জাতীয়’ মহাসমিতি কংগ্রেসের সভ্যপদপ্রার্থী হইলেন। অনেকেই উকিল হইয়া আইন ব্যবসায় ধরিতে চেষ্টা করিলেন। কেহ কেহ ছোট বড় চাকরীর সন্ধান করিতে লাগিলেন। অনেকেই সঙ্গীত-শিক্ষকতার কর্ম্ম করিতে থাকিলেন। আমি বুঝিলাম নিগ্রোসমাজের উন্নতি এই কংগ্রেসওয়ালা উকিল, কেরাণী বা সঙ্গীত-শিক্ষকগণের দ্বারা সাধিত হইবে না।! তাহার জন্য অন্যরূপ তপস্যা আবশ্যক। এমন কি কংগ্রেসের কার্য্য, উকিলী ব্যবসায় এবং সঙ্গীত-শিক্ষকতার কর্ম্মের জন্য ও নিগ্রোদিগকে যোগ্য করিয়া তুলিবার জন্যই কঠোর সাধনা আবশ্যক। সেই তপস্যায় ও সেই সাধনায় ব্রতী না হইয়া কেবল উচ্চ আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চ অভিলাষ পোষণ করিলে কি হইবে?

 আমার স্বজাতিদিগের এই সময়কার হাব ভাব দেখিয়া আমাদের গোলামীযুগের একটা ঘটনা মনে পড়িত। এক নিগ্রো সেতার বাজান শিখিতে চাহিয়াছিল। তাহার একজন যুবক প্রভু সেতার বাজাইতে পারিতেন। তাঁহার নিকট সে মনোবাঞ্ছা জানাইল। প্রভু বুঝিলেন, নিগ্রোর ইহা সাধ্য নয়। মজা দেখিবার জন্য বলিলেন, “আচ্ছা, জ্যাক্ দাদা, তোমাকে আমি সেতার শিখাইতে রাজী আছি। কিন্তু দাদা একটা কথা বলি। এজন্য কত করিয়া আমাকে দিবে? আমার দস্তুর এই—প্রথম গৎ শিখাইবার জন্য আমি ৯৲ লইয়া থাকি, দ্বিতীয় শিক্ষার জন্য ৬৲ লইয়া থাকি এবং তৃতীয়টার জন্য আমি মাত্র ৩৲ লই। আর যেদিন তোমাকে ওস্তাদ করিয়া ছাড়িয়া দিব অর্থাৎ শেষ দিন মাত্র ৸১০ লইব। রাজী আছ কি?” নিগ্রো দাদা উত্তর করিল, “ছোট কর্ত্তা, কড়ারটা ত ভালই দেখিতেছি। তোমাকে আমি এইরূপই দিয়া যাইব। কিন্তু কর্ত্তা আমার একটা অনুরোধ রাখিতে হইবে। তুমি শেষ গৎটাই আমাকে প্রথমে শিখাও না কেন?”

 আমি আমাদের স্বজাতিদিগের জন-নায়ক ও বড় বড় কর্ম্মচারী ইত্যাদি হইবার আকাঙ্ক্ষাকে এই গোলামের শেষ গৎটাই আগে শিখিবার ইচ্ছার ন্যায় সর্ব্বদা মনে করিয়া আসিয়াছি। এজন্য আমি ওসব ‘বড় কাজে’ না যাইয়া নীরব শিক্ষাপ্রচার কর্ম্মেই থাকিয়া গেলাম।

 চার্লষ্টনে রাষ্ট্রকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হইল। আমি ম্যাল্‌ডেনে শিক্ষকতা করিতে লাগিলাম। এমন সময়ে একখানা হ্যাম্পটনের পত্র পাইলাম। সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গ আমাকে হ্যাম্পটনে একটা বক্তৃতা করিতে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। প্রতি বৎসর কার্য্য আরম্ভ হইবার পূর্ব্বে হ্যাম্পটনের পুরাতন গ্রাজুয়েটদের মধ্যে দুএকজন বক্তৃতা করিয়া থাকেন। এবার আমার উপর এই ভার পড়িল। আর্মস্ট্রঙ্গের পত্র পাইয়া এক সঙ্গে লজ্জিত ও আনন্দিত হইলাম। আমি এই সম্মানলাভের যোগ্য বিবেচিত হইয়াছি দেখিয়া আশ্চর্যান্বিতও হলাম। যাহা হউক, কিছু দিনের মধ্যেই বক্তৃতা প্রস্তুত করিয়া ফেলিলাম। আমার আলোচ্য বিষয় হইল “বিজয়লাভের সদুপায়।”

 পাঁচ বৎসরের মধ্যে নূতন রেলপথ অনেক খোলা হইয়াছে। হ্যাম্পটনে যাইবার সময়ে এবার সমস্ত রাস্তা রেলপথেই গেলাম। পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে কি কষ্টে আমি কত পথ হাঁটিয়া কত দিন না খাইয়া সেই একই রাস্তায় হ্যাম্পটনের বিদ্যামন্দিরে উপস্থিত হইয়াছিলাম! আজ আমি সেইখানে সম্মানজনক পদলাভ করিয়া বক্তৃতা দিতে চলিয়াছি। অতীত ও বর্ত্তমান তুলনা করিতে করিতে শরীর রোমাঞ্চিত হইতে লাগিল। পাঁচ বৎসরের মধ্যে কোন লোকের এরূপ ভাগ্য পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে কি না আমার জানা নাই।

 হ্যাম্পটনে শিক্ষক ও ছাত্রগণ আমাকে খুবই আদর আপ্যায়িত করিলেন। আমি অনেক দিন পরে আসিয়াছি, বহু বিষয়ে পরিবর্ত্তন ও উন্নতি লক্ষ্য করিলাম। আমাদের সমাজের যে যে বিষয়ে অসম্পূর্ণতা ও অভাব রহিয়াছে বিদ্যালয়ে ঠিক সেইগুলি পূরণ করিবার জন্যই আর্মষ্ট্রঙ্গ মহোদয় এবং হ্যাম্পটনের শিক্ষক শিক্ষয়িত্রাগণ চেষ্টিত ছিলেন।

 অনেক স্থলে দেখিয়াছি, শিক্ষা প্রচারকেরা সমাজের অবস্থা বুঝিয়া বিদ্যাদানের ব্যবস্থা করেন না। অবনত ও দরিদ্র লোকসমাজে শিক্ষাবিস্তার করিতে যাইয়া বহু সৎপ্রয়াসী কর্ম্মিগণ এজন্য সুফল সৃষ্টি করিতে পারেন নাই। অন্য এক সমাজে যে অনুষ্ঠানে সুফল লাভ হইয়াছে তাহাই অবনত সমাজে প্রবর্ত্তন করিতে যাইয়া তাঁহারা বিফল হইয়াছেন। তাঁহারা বুঝেন না যে, এক সমাজের যাহা শুভ, অন্য সমাজের তাহা অশুভও হইতে পারে। শ্বেতকায় সমাজে যাহাকে উন্নত শিক্ষাপ্রণালী বলি তাহাই যে কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রোসমাজেও সুফল প্রসব করিবে কে বলিতে পারে? এমন কি, পূর্ব্ববর্ত্তী কোন যুগে হয়ত একটা অনুষ্ঠানের দ্বারা সুফল পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহার দ্বারাই যে এখনও উপকার হইবে এরূপ বিশ্বাস করা যাইতে পারে কি? কিন্তু শিক্ষাপ্রচারকেরা দেশকালপাত্র বিবেচনা না করিয়াই অনেক ক্ষেত্রে কর্ম্মে অবতীর্ণ হইয়াছেন, দেখিতে পাই। ১০০০ মাইল দূরে কোন দেশে যে শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্ত্তিত হইয়াছে তাহাই অন্ধের ন্যায় ইহাঁরা হয়ত কোন সমাজে প্রচার করিতে থাকেন। অথবা ১০০ বৎসর পূর্ব্বে যে বিদ্যা কার্য্যকরী ছিল এতদিন পরেও তাঁহারা তাহাই চালাইতেছেন। হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষেরা এরূপ অনভিজ্ঞ ছিলেন না। তাঁহারা জানিতেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাঁহারা রহিয়াছেন। তাঁহারা বুঝিতেন যে, নিগ্রোজাতির জন্য তাঁহারা ব্যবস্থা করিতেছেন। আর তাঁহারা মনে রাখিতেন যে, যুক্তরাজ্যের একটি প্রদেশের মধ্যেই তাঁহাদের কর্ম্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত।

 শিক্ষাবিস্তার বিষয়ে আর একটা দোষও অনেক সময়ে লক্ষ্য করিয়াছি। শিক্ষকেরা মনে করেন যে, ছাত্রেরা সকলেই একরূপ, সকলকেই একই প্রণালীতে, একই আদর্শে, একই জীবনযাপন প্রথার ভিতর দিয়া মানুষ করা যায়। এজন্য সকলের উপর একটা ‘পেটেণ্ট’ ছাপ মারিয়া দিবার জন্য শিক্ষকেরা সাধারণতঃ চেষ্টা করিয়া থাকেন। তাঁহারা ভুলিয়া যান যে, মানুষ বিচিত্র, ছাত্রগণের স্বভাব বিভিন্ন, এক একজনের এক এক প্রকার মেজাজ, প্রবৃত্তি ও ধারণা। সুতরাং প্রত্যেকের অভাব বুঝিয়া শিক্ষা দিলেই সুফল ফলিতে পারে। সুখের কথা হ্যাম্পটনে ছাত্রদের বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা বিষয়ে বেশ লক্ষ্য রাখা হইত। এক একজনকে এক এক প্রকার শিল্প, কৃষি ও পুঁথি শিখান হইত। ফলতঃ ছাত্রেরা সজীবভাবে মনের আনন্দে বাড়িয়া উঠিত। যাহার যে বিষয়ে অভাব তাহার ঠিক সেই বিষয়েই শিক্ষা হইত। লেখা পড়া শিখিয়া যে তাহাদের উপকার হইতেছে প্রতিদিন তাহারা ইহা নিজেই বুঝিতে পারিত।

 হ্যাম্পটনে আমার বক্তৃতা দেওয়া হইয়া গেল। সকলে খুসী হইলেন। আমি ম্যাল্‌ডেনে ফিরিয়া আসিলাম। এখানে শিক্ষকতার জন্য পুনরায় ব্যবস্থা করিতেছি এমন সময়ে আর্মষ্ট্রঙ্গ মহোদয়ের আর একখানা পত্র পাইলাম। তিনি আমাকে হ্যাম্পটনে একটা শিক্ষকতার পদে নিযুক্ত করিয়াছেন।

 ইতিমধ্যে আমি আমার দুইটি ভাই ও আমার পল্লীর অপর চারিজন সর্ব্বসমেত ছয় জন ছাত্রকে ম্যাল্‌ডেন হইতে হ্যাম্পটনে পাঠাইয়াছি। তাহাদিগকে আমি ঘরেই এতদূর তৈয়ারী করিয়া দিয়াছিলাম যে তাহারা হ্যাম্পটনে যাইয়া সকল বিষয়েই উচ্চ শ্রেণীতে ভর্ত্তি হইবার সুযোগ পাইয়াছিল। ইহাদের লেখাপড়া এবং স্বভাব চরিত্র দেখিয়া আর্মষ্ট্রঙ্গ আমার গুণপনায় মুগ্ধ হইয়াছিলেন এবং ভাবিয়াছিলেন, আমার দ্বারা বেশ ভালই শিক্ষকতার কার্য্য চলিতে পারে। এজন্যই তিনি উৎসুক হইয়া আমাকে হ্যাম্পটনে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। আমি যে সকল ছাত্র পাঠাইয়াছিলাম তাহাদের মধ্যে একজন আজ কাল বোষ্টন নগরে প্রসিদ্ধ চিকিৎসা ব্যবসায়ী। তিনি ঐ নগরে শিক্ষা পরিষদেরও একজন সদস্য।

 এই সময়ে আর্মষ্ট্রঙ্গ মহোদয় লোহিত জাতিকে শিক্ষা দিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। তখনকার দিনে কেহই বিশ্বাস করিতে পারিত না, যে, লোহিতবর্ণ ইণ্ডিয়ান জাতির লোকেরা লেখাপড়া শিখিয়া সভ্য হইতে পারিবে। আর্মষ্ট্রঙ্গ কিন্তু পরীক্ষা করিতে কৃতসঙ্কল্প। তিনি ফেডারেল দরবারের সাহায্যে প্রায় ১০০ লোহিত শিশু ও যুবক হ্যাম্পটনে লইয়া আসিলেন। তাহাদিগকে বিদ্যালয়ের মধ্যেই রাখিলেন। আমি তাহাদিগের ভরণপোষণ রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদির ভার প্রাপ্ত হইলাম। এই কার্য্য আমায় খুব ভালই লাগিত সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি আমার স্বজাতির জন্য কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া এই নূতন এক লোকসম্প্রদায়ের সেবায় নিযুক্ত হইতে তত বেশী উৎসাহী ছিলাম না। কিন্তু আর্মষ্ট্রঙ্গের আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া লইলাম।

 প্রায় ৭৫ জন লোহিত ইণ্ডিয়ান্ আমার রক্ষণাবেক্ষণে থাকিল। আমি ছাড়া তাহাদিগের নিকট আমাদের স্বজাতীয় আর কেহ ছিল না। কাজেই দায়িত্ব আমার যথেষ্ট। একে ত ইণ্ডিয়ানেরা শ্বেতকায় দিগকেই সম্মান করে না। তাহারা শ্বেতাঙ্গ অপেক্ষা উন্নত ও সভ্য এইরূপই তাহাদের বিশ্বাস। কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রোরা তাহাদিগের কাছে উল্লেখযোগ্য জাতিই নয়। তাহার উপর আমরা এত কাল গোলামী করিয়াছি। ইণ্ডিয়ানেরা “যায় প্রাণ থাকে মান” ভাবিয়া কোন দিনই গোলাম হয় নাই। এমন কি তাহারাই তাহাদের দেশে অনেক ক্রীতদাস রাখিত। সুতরাং জাতিসমস্যা মীমাংসা করিবার জন্য আমাকে প্রথম প্রথম বড় বেশী ভাবিতে হইয়াছিল।

 অধিকন্তু সকলেরই ধারণা জন্মিয়াছিল, আর্মষ্ট্রঙ্গের এই চেষ্টা ফলবতী হইবে না। তিনি একটা অসাধ্য সাধন করিতে প্রয়াসী হইয়াছেন।

 যাহা হউক, অল্পকালের মধ্যেই আমি ইণ্ডিয়ান্‌দিগের বন্ধু হইয়া পড়িলাম। আমি তাহাদের তাহারা আমার এই ভাব বেশ জমিয়া গেল। আমাদের মধ্যে বেশ সদ্ভাব ও প্রীতি এবং ভালবাসার সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হইল। আমি দেখিলাম, লোহিত ইণ্ডিয়ানেরাও মানুষ—তাহাদেরও হৃদয় আছে—তাহারাও ভালবাসিতে জানে—তাহারাও সদসৎ বুঝিয়া কর্ম্ম করিতে পারে। ক্রমেই দেখিলাম তাহারা আমাকে সুখী করিবার জন্য কত কি করিতে চাহিত।

 তাহাদের একটা ‘গোঁ’ ছিল। তাহারা তাহাদের স্বজাতির চিহ্নস্বরূপ চুলগুলি কাটিতে দিত না। কম্বল মুড়ি দিয়া বেড়াইতেও তাহারা ভাল বাসিত—এ অভ্যাস তাহারা ছাড়িতে চাহিত না। ধূমপানের অভ্যাসও তাহাদের একটা জাতায় চরিত্রের অন্তর্গত ছিল। তাহাদিগকে কোন মতে ইহা বন্ধ করান যাইত না। কিন্তু দোষ কি? সকল জাতিরই কতকগুলি ‘গোঁ’ থাকে। শ্বেতাঙ্গ জাতিদেরই কি কতকগুলি খেয়াল নাই? তাঁহারা পৃথিবীর সকল জাতিকেই তাঁহাদের ধর্ম্ম, তাঁহাদের ভাষা, তাঁহাদের পোষাক, তাঁহাদের খানা ইত্যাদি ব্যবহার করিতে পীড়াপীড়ি করেন। যেন সাদা চামড়াওয়ালা লোকেরা যাহা যাহা করে অন্যান্য জাতির লোকেরা ঠিক সেইরূপ অনুকরণ না করিলে তাহারা সভ্য হইতে পারে না। সুতরাং লোহিত শিশু ও যুবকদিগের স্বাভাবিক অভ্যাসগুলিতে আমি বিশেষ বিরক্ত হইতাম না।

 আমার বিশ্বাস—কৃষ্ণাঙ্গ ও লোহিত ছাত্রদিগের মস্তিষ্কে কোন প্রভেদ নাই। তাহারা বোধ হয় ইংরাজী শিখিতে কিছু বেশী সময় লইত। অন্যান্য সকল বিষয়ে দুইএরই প্রতিভা এক প্রকার। কৃষি, শিল্প, ব্যবসায় অথবা ভূগোল ইতিহাস ইত্যাদি শিক্ষা করিবার জন্য নিগ্রো ও ইণ্ডিয়ান দুই জাতিরই একপ্রকার যোগ্যতা ও অযোগ্যতাই ছিল।

 হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের নিগ্রো ছাত্রেরা নানা উপায়ে ইণ্ডিয়ানদিগকে সাহায্য করিত। ইহাতে আমি বিশেষ সন্তুষ্টই হইতাম। নিগ্রোরা অনেক সময়ে লোহিতদিগকে নিজ ঘরে থাকিতে দিত। ইণ্ডিয়ানেরা এইরূপে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত নিগ্রোদিগের সহবাসে থাকিয়া ইংরাজী ভাষা সহজে আয়ত্ত করিতে পারিত।

 হ্যাম্পটনের কাল ছেলেরা এই লাল ছাত্রদিগকে যেরূপ বন্ধুভাবে গ্রহণ করিতেছিল, যুক্তরাজ্যের কোন অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গ সন্তানেরা অন্য কোন জাতির ১০০ ছাত্রকে সেইরূপ হৃদ্যতার সহিত গ্রহণ করিতে পারে কি না সন্দেহ। আমি কতবার শ্বেতাঙ্গ যুবকদিগকে বলিয়াছি “যতই তোমরা অবনত জাতিকে উন্নত করিতে চেষ্টা করিবে ততই তোমরা নিজেই উন্নত হইবে। সেই অবনত জাতি যেই পরিমাণে অবনত ছিল তোমাদের উন্নতি ও সভ্যতা ঠিক সেই পরিমাণে বাড়িতে থাকিবে।”

 এই উপলক্ষ্যে আমার একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। মাননীয় শ্রীযুক্ত ফ্রেড্‌রিক্ ডগলাস এক সময়ে পেনসিল ভেনিয়া প্রদেশে রেলে বেড়াইতেছিলেন। তিনি কৃষ্ণবর্ণ নিগ্রো। রেল কোম্পানীকে তিনি পয়সা সমানই দিয়াছেন—কিন্তু তিনি শ্বেতাঙ্গদিগের সঙ্গে এক গাড়ীতে বসিতে পাইলেন না। তাঁহাকে মাল গাড়ীতে অন্যান্য নিগ্রোর সঙ্গে বসিয়া যাইতে হইল। একজন শ্বেতাঙ্গ বন্ধু সেই মালগাড়ীতে যাইয়া ডাগলাসকে বলিলেন “মহাশয়, আমরা আপনার এই অপমান দেখিয়া বড়ই দুঃখিত হইয়াছি।” ডাগলাস সোজা হইয়া বসিলেন এবং সদর্পে উত্তর করিলেন “ডাগলাসকে অপমান কে করিতে পারে? আমার আত্মাকে কোন বাহিরের লোক স্পর্শ করিতে পারে কি? আমি বলিতেছি, এই ব্যবহারে আমার বিন্দুমাত্র অসম্মান বা নিন্দা হয় নাই। যাহারা এইরূপ দুর্ব্ব্যবহার করিয়াছে তাহারাই যথার্থ নীচাশয় এবং নিন্দনীয় হইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের হৃদয়েই কালিমা জমা হইতেছে।”

 আমি রেলপথের আর একটা নিগ্রোসমস্যার ঘটনা উল্লেখ করিতেছি। একজন নিগ্রোর সমস্ত শরীর অতিশয় সাদা ছিল। তাহাকে কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রোদিগের সঙ্গে তুলনা করিয়া কেহই তাহার জাতি স্থির করিতে পারিত না। সে এক সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদিগের গাড়ীতে বসিয়া যাইতেছে। টিকেট-সংগ্রাহক তাহাকে সেইখানে দেখিয়া থম্‌কাইয়া দাঁড়াইল। সে কি নিগ্রো না ইয়াঙ্কি? তাহার মনে এই সন্দেহ উপস্থিত হইল। যদি সে নিগ্রো হয়, ভালই। কিন্তু যদি সে শ্বেতাঙ্গ হয় তাহা হইলে তাহাকে কি করিয়া জিজ্ঞাসা করা যায় যে সে নিগ্রো কি না? ইহাতে শ্বেতাঙ্গের অপমান হইবারই সম্ভাবনা। টিকেট সংগ্রাহক সেই ব্যক্তির আপাদ মস্তক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করিল। তাহার চুল, চোখ, হাত, কান কিছুই বাকী রাখিল না। কোনমতেই বুঝা গেল না যে ঐ লোক নিগ্রো কি সত্য সত্যই শ্বেতাঙ্গ। শেষে উপায় না দেখিয়া লোকটা মাথা হেঁট করিয়া তাহার পায়ের দিকে দেখিতে থাকিল। আমি সেই গাড়ীতে বসিয়াছিলাম এবং রেলের কেরাণীর ঐ পরীক্ষা দেখিয়া মনে মনে ভাবিলাম “যাহাহউক, এইবার সন্ধান পাওয়া যাইবে।” সত্যই তাহার পা দেখিয়া সে বুঝিল যে ঐ ব্যক্তি নিগ্রোই বটে এবং তাহাকে কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। আমি সুখী হইলাম যে গোলমালে আমার একজন স্বজাতি কমিয়া গেল না!

 আমি ভদ্রতা সম্বন্ধে একটা নিয়ম স্থির করিয়াছি। কোন লোক সভ্য ও ভদ্র কিনা তাহা বিচার করিবার জন্য আমি কোন নীচ জাতির লোকের সঙ্গে তাহার আচার ব্যবহার পরীক্ষা করিয়া থাকি। পূর্ব্বে গোলামীর যুগে দক্ষিণ প্রান্তের শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা তাঁহাদের ক্রীতদাসগণের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করিতেন তাহাতে তাঁহাদের মধ্য হইতে ভদ্র ও অভদ্র, সভ্য ও অসভ্য খুঁজিয়া বাছা সহজ ছিল। এখনও পুরাতন মনিবের সন্তানেরা পুরাতন গোলামবংশীয়দিগের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করিয়া থাকে তাহাই ভদ্রতা বিচারের প্রকৃষ্ট মাপকাঠি।

 জর্জ্জ ওয়াশিংটন একদিন রাস্তায় হাঁটিতে ছিলেন এমন সময়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রো তাঁহাকে টুপি তুলিয়া নমস্কার করিল। তিনি তৎক্ষণাৎ নিগ্রোকে তাঁহার টুপি খুলিয়া নমস্কার করিলেন। তাঁহার শ্বেতাঙ্গ বন্ধুরা এজন্য তাঁহাকে পরে নিন্দা করিতেন। তিনি উত্তর দিতেন:—“তোমরা কি বলিতে চাহ যে, একটা অশিক্ষিত অসভ্য নিগ্রো আমাকে ভদ্রতায় হারাইয়া দিবে?”

 আমেরিকায় জাতি ভেদের দুই একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি। আমি যখন হ্যাম্পটনে লোহিত ছাত্রদিগের অভিভাবকতা করিতেছিলাম সেই সময়ে আমার অধীনস্থ একজন ছাত্রের অসুখ হয়। আমি তাহাকে সঙ্গে লইয়া “ফেড্‌রাল দরবারে”র কর্ম্মচারীর নিকট ওয়াশিংটনে যাইতেছিলাম। তিনি ইহাকে যথা স্থানে তাহার স্বদেশে পাঠাইয়া দিবেন। ওয়াশিংটনে যাইবার পথে খানিকটা একটা ষ্টীমারে যাইতে হয়। উহাতে হোটেল ছিল। সকলের খাওয়া দাওয়া হইয়া যাইবার পর আমি সেখানে খাইতে গেলাম। আমার লোহিত ছাত্রও আমার সঙ্গে ছিল। ষ্টীমারের হোটেলওয়ালা বলিল “লোহিত যুবক খানা পাইবে, তুমি পাইবে না।” আমি অবশ্য বিস্মিত হইলাম—কারণ আমাদের দুইজনের রঙ্গে বড় বেশী তফাৎ ছিল না। কিন্তু সে এত ওস্তাদ যে দেখিবা মাত্রই কৃষ্ণ লোহিত সহজেই চিনিয়া ফেলিয়াছে!

 তাহার পর আর একটা হোটেলেও এইরূপ ঘটিল। আমি হ্যাম্পটন হইতে আসিবার সময় সেই হোটেলে থাকিতে আদিষ্ট হইয়া ছিলাম। কিন্তু তাহারাও আমাকে জায়গা দিল না।

 জাতিভেদের আর একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি। একবার একটা সহরে মহাগোলযোগ পড়িয়া যায়। একজন লোককে “লিঞ্চ” বা সজ্ঞানে মারিয়া ফেলিবার যোগাড় হইয়া উঠিল। ব্যাপার কি অনুসন্ধানে জানা গেল যে কাল চামড়ার একটা লোক স্থানীয় হোটেলে খাইতে গিয়াছে। কিন্তু সে নিগ্রো নয় সে মরক্কো দেশের একজন অধিবাসী, আমেরিকায় বেড়াইতে আসিয়াছে। তাহার রং কাল এবং ইংরাজীতে সে কথা বলিতে পারিত। কাজেই লোকেরা তাহাকে নিগ্রো ভাবিয়া লইয়াছিল। যখন রটিয়া গেল যে, সে নিগ্রো নয় আর কোন গোলযোগ থাকিল না। তাহার পর হইতে মরক্কোবাসী ব্যক্তিটি ইংরাজীতে কথা না বলাই শ্রেয়জ্ঞান করিয়াছিল।

 লোহিত ছাত্রদের লইয়া হ্যাম্পটনে এক বৎসর কাটাইলাম। এই সময়ে আমার ভবিষ্যৎ উন্নতির আর একটা সুযোগ জুটিল। তাহার ফলে আমার টাস্কেজির কর্ম্মে যথেষ্ট সাহায্য হইয়াছে। আর্মষ্ট্রঙ্গ দেখিলেন, নূতন নূতন নিগ্রো পুরুষ ও রমণীরা দলে দলে শিক্ষালাভের জন্য তাঁহার নিকট আবেদন করিতেছে। কিন্তু তাহাদের বড়ই দুরবস্থা। পয়সা দিয়া স্কুলে থাকা কঠিন, এমন কি, দুই চারি খান কেতাব কিনিবার ক্ষমতাও তাহাদের নাই। সেনাপতি মহাশয় ইহাদিগের জন্য একটা নৈশবিদ্যালয় খুলিবার আয়োজন করিলেন।

 ব্যবস্থা হইল যে তাহারা দিনে ১০ ঘণ্টা করিয়া খাটিবে এবং রাত্রে ২ ঘণ্টা মাত্র স্কুলে পড়িবে। এই কাজের জন্য তাহাদিগকে বিদ্যালয় হইতে খোরাক দেওয়া হইবে। তাহা ছাড়া নগদও কিছু তাহাদিগকে দেওয়া যাইবে। এই নগদ টাকাটা সম্প্রতি তাহারা বিদ্যালয়ের ধনভাণ্ডারে জমা রাখিবে। ভবিষ্যতে তাহাদিগকে দিবাভাগের বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিয়া লওয়া যাইবে। তখন ঐ পুঁজি হইতে তাহাদের খোরাক পোষাক চলিতে পারিবে। অবশ্য এইরূপে অন্ততঃ দুই বৎসর কাল নৈশ-বিদ্যালয়ে না থাকিলে তাহারা দিবা-বিদ্যালয়ের উপযুক্ত বিবেচিত হইবে না—এবং দিবা-বিদ্যালয়ের জন্য নিজ নিজ অভাবমোচনোপযোগী টাকাও জমা হইয়া উঠিবে না। অধিকন্তু এই দুই বৎসরব্যাপী জীবনযাপনের ফলে তাহারা কতকগুলি শিল্প ও কৃষিকর্ম্ম শিখিয়া ফেলিবে। তাহাদের পুঁথিবিদ্যাও কিছু কিছু হইয়া থাকিবে। এদিকে হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ের ও কৃষিবিভাগ এবং শিল্পবিভাগ সবিশেষ পুষ্টিলাভ করিবে। সুতরাং এই নৈশবিদ্যালয়ের দ্বারা অশেষ উপকার হইবার সম্ভাবনা।

 আর্মষ্ট্রঙ্গ মহোদয় তাঁহার এই নব প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ের ভার আমায় দিলেন। প্রায় ১২ জন উৎসাহী ও কর্ম্মঠ ছাত্র ও ছাত্রী লইয়া নৈশবিদ্যালয়ের কার্য্য আরম্ভ করা গেল। দিবাভাগে পুরুষেরা বিদ্যালয়ের করাতখানায় কাজ করিত এবং মেয়েরা ধোপার কর্ম্ম করিত। দুই কাজই অত্যধিক কঠিন ছিল। কিন্তু তাহারা বেশ ভাল করিয়া করিত। এদিকে নৈশবিদ্যালয়ের জন্য পড়া প্রস্তুতও তাহারা মনোযোগের সহিত করিত। লেখাপড়া শেষ করিবার ঘণ্টা বাজিয়া গেলেও তাহারা উহাতে লাগিয়া থাকিত। ঘুমাইতে যাইবার সময় হইয়া যাইবার পরেও তাহারা আমাকে তাহাদিগের পড়া বুঝাইয়া দিতে অনুরোধ করিত।

 ইহাদিগের দিনের ও রাত্রের কাজ দেখিয়া আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম। ইহাদের পরিশ্রম স্বীকার এবং বিদ্যাভ্যাসে মনোযোগের জন্য ইহাদিগকে আমি একটা নূতন নাম দিয়াছিলাম। তাহাদিগকে “কর্ম্মঠ সমিতির” সদস্য বলিয়া ডাকিতাম। ক্রমে হ্যাম্পটন বিদ্যালয়ের মধ্যে তাহাদের সুনাম ছড়াইয়া পড়িল—হ্যাম্পটনের বাহিরেও এই নামের আদর হইতে লাগিল। নৈশবিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকে আমি ছাপান সার্টিফিকেটও দিতে আরম্ভ করিলাম। তাহাতে এইরূপ লেখা থাকিত—

“হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ের ‘কর্ম্মঠ-সমিতি’র ‘অমুক’... ‘অত’বৎসর নিয়মিতরূপে কার্য্য করিয়া এই প্রশংসা পত্রের অধিকারী হইয়াছে।” সমাজে এই প্রশংসা পত্রগুলির আদর বাড়িতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাম্পটনের নামও সর্ব্বত্র ছড়াইয়া পড়িল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ছাত্র সংখ্যা বাড়িয়া গেল। আজ সেই নৈশবিদ্যালয়ে ৩০০। ৪০০ ছাত্র লেখা পড়া শিখিয়া থাকে। ইহার ছাত্রেরা ইতিমধ্যে দেশের নানা সৎকর্ম্মে উচ্চস্থানও অধিকার করিয়াছে।